ভারতে ২০০ বছরের ইংরেজ শাসনের অবসান হয়েছে প্রায় ৭৪বছর হতে চলল কিন্তু আজও ব্রিটিশ শাসনের বহু স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেশের প্রতিটি কোনায়।তবে ব্রিটিশ ঐতিহ্য বহন করার ক্ষেত্রে দেশের অন্যান্য রাজ্য গুলোর থেকে তিলোত্তমা কলকাতা কোন অংশেই কম নয়, বরং বলা চলে একদা ব্রিটিশ আমলে ভারতের রাজধানী হিসেবে পরিচিত শহর কলকাতার প্রায় প্রতিটি স্থাপত্যেই রয়েছে প্রাচীন বিদেশি শিল্পের ছোঁয়া। তবে তৎকালীন ইংরেজ শাসকদের কাছে কলকাতাই কেবল মাত্র গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা মোটেই বলা যায় না,কারন কলকাতাকে তারা শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্র রূপে ব্যবহার করলেও, ব্যস্ততার মাঝে একটু নিরিবিলিতে থাকার জন্য কিন্তু বেছে নিতেন কলকাতার আশেপাশের জায়গা গুলোকেই। সেরকমই ইংরেজ শাসনের অনেক চিহ্নই আজও বুকে আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্যারাকপুর। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসে পূর্বভারতে দুটি বিদ্রোহ হয়েছিল, যার প্রথমটা ১৮২৪ সালে সিপাহী বিন্দা তিওয়ারির নেতৃত্বে আর অন্যটি ১৮৫৭ সালে মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে। এই অভিজ্ঞতা দুটি বাদ দিলে তৎকালীন ব্রিটিশ রাজপুরুষদের কাছে ব্যারাকপুর বরাবরই পরিচিত ছিল বিশ্রামের এক শান্ত দেশীয় আবাস হিসাবে।

তখন পলাশীর যুদ্ধের প্রায় দশ বছর কেটে গেছে। ততদিনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যও ভারতে বেশ ভালো ভাবেই বিস্তার লাভ করেছে, ধীরে ধীরে ব্যারাকপুরে গড়ে উঠেছে ব্রিটিশদের সেনা নিবাস। তারও কিছুটা পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফে ভারতের দায়িত্ব সামলাতে এদেশে এলেন লর্ড ওয়েলেসলি।তবে ব্যারাকপুর নিয়ে তার পরিকল্পনা গুলো বাস্তবায়নের মাঝে হঠাৎই কম্যান্ডার ইন চিফের বাড়িটির দায়িত্ব তার হাতে চলে আসে। বাড়িটির পরিবেশ তার এতোই পছন্দ হয়ে যায় যে তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বোর্ডে তার পরিকল্পনা পেশ করার সাথে সাথে শুরু করলেন ওই বাড়িটি ঘিরে তার স্বপ্নের নীড় গড়ার কাজ। কিন্তু কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ফিরে যেতে হয় তাকে, তবে পরবর্তী সময়ে এই বাড়িটি হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ রাজপুরুষ ও তাদের পরিবার বর্গের কাছে আমোদ-প্রমোদের এক সেরা ঠিকানা। এমনকি বাংলার তৎকালীন বড়লাট লর্ড ক্যানিং নিজের স্ত্রীর দেহ সমাহিত করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন এই বাড়ির বাগানের শান্ত নিরিবিলি এক টুকরো অংশ। ছায়া সুনিবিড় নদীতীরের সেই অপূর্ব অংশে যেখানে তার স্ত্রী কাটিয়েছিলেন জীবনের দীর্ঘ সময় সেখানেই স্থাপন করেছিলেন তার শেষ সমাধি।
স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ ঐতিহ্য বহনকারী এই সৌধ গুলির সব সম্পত্তি আসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে, গড়ে ওঠে বিভিন্ন সরকারি দপ্তর। যেমন, এককালের গভর্নর জেনারেলের প্রাইভেট সেক্রেটারির আবাস ‘ ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউস’ আজ পরিণত হয়েছে রাজ্যপালের গ্রীষ্মকালীন আবাসে, ব্যারাকপুর পার্কের সৌধটি পরিণত হয় পুলিশ হাসপাতালে এবং পরবর্তী সময়ে এখানেই গড়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুলিশ ট্রেনিং স্কুল।

সাম্প্রতিক কালে এই পুলিশ ট্রেনিং স্কুলের দায়িত্বে আসেন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্তা সৌমেন মিত্র। ইতিহাস প্রেমী এই অফিসারের উদ্যোগে শুরু হয় এই ঐতিহাসিক স্থান পুনরুদ্ধার এবং সংরক্ষনের কাজ। হেরিটেজ কমিশনের সহায়তায় সৌধ ও ভবন সংস্কারের কাজ শুরু হওয়ায় আজ সংস্কারকৃত সৌধের সামনে বিরাজমান হয়েছে পদ্ম ফোয়ারা। মতিঝিল,সার্পেন্টাইন লেক, হর্স শু লেক পরিষ্কার করার সাথে সাথে নব রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে লেডি ক্যানিংয়ের সমাধি সৌধ ও তার প্রাঙ্গন। বাড়ি বিভিন্ন অংশের সংস্কারের কাজও প্রায় সম্পূর্ণ হওয়ার পথে, সামান্য যত্নের ছোঁয়ায় গ্রেট বেনিয়ান ট্রি আজ অনেকটাই সুরক্ষিত।অতীতের স্মৃতি সংরক্ষিত হওয়ায় আজ তা পরিণত হয়েছে শহরের অন্যতম দর্শনীয় হেরিটেজ সাইটে।