“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারী , আমি কি ভুলিতে পারি।” না , আমরা ভুলিনি, বাঙালি ভোলেনি। প্রতিবছর সাড়ম্বরে, শ্রদ্ধায়, আবেগ দিয়ে পালন করা ২১-শে ফেব্রুয়ারী দিনটি। কিন্তু বাঙালি হয়তো ভুলতে বসেছে আজকের দিনটি অর্থাৎ ১৯শে মের কথা , যে দিনটির গুরুত্ব কিছু কম নয় বাংলা ভাষার জন্য। ১৯৬১ সালে আজকের দিনে অসমের শিলচর রেলস্টেশনে শান্তিপূর্ণ ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি বর্ষণ করা হয় এবং মারা যান এগারোজন তরুন তরুণী। মাতৃ ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন – ১৬ বছরের ছাত্রী কমলা ভট্টাচার্য , ১৯ বছরের ছাত্র শচীন্দ্র পাল , পেশায় কাঠমিস্ত্রি বছর ২২ এর চণ্ডীচরণ সূত্রধর এবং বছর ২৪ এর বীরেন্দ্র সুত্রধর , দোকান কর্মচারী বছর ২৪ এর কুমুদ দাস এবং সত্যেন্দ্র দেব, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বছর ২২ এর হিতেশ বিশ্বাস, তরণী দেবনাথ,সুনীল সরকার ,সুকোমল পুরকায়স্থ এবং বছর ৩৭ এর রেলকর্মী কানাই লাল নিয়োগী।
মাতৃ ভাষার জন্য এই ১১ জন তরুণ তরুণী অকালে প্রাণ হারিয়েছিলেন।
ভারত তথা বাংলা ভাগের পরে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ যেমন রয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে সেরকমই বাংলা ভাষাভাষীদের একটা বড়ো অংশ রয়ে গিয়েছিলো অসমপ্রদেশে। সালটা ১৯৫৫, সেই সময় থেকেই বাঙালিদের ওপর শুরু হয় অত্যাচার। ধুবড়ি, বরপেটা ,গোয়ালপাড়া অঞ্চলে একের পর এক বাঙালিরা আক্রান্ত হতে থাকেন। এই জনরোষের ফলে কয়েক হাজার বাঙালি পালয়ে যান ,নিজের জায়গা-বসতবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন। ওই অরাজগতার মধ্যে তখনও বাঙালিরা একত্রিত হয়ে আন্দোলনের সাহস পাননি।
যে আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে সেই আন্দোলনের শুরু বলা যেতে পারে ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে যখন অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র রাজ্যভাষা রূপে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব দেয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি। সেই বছরেরই অক্টোবর মাসে বিধানসভায় রাজ্যভাষা বিলের খসড়া পেশ করা হয়। কিন্তু এরই মধ্যে বরাক উপত্যকার ,তৎকালীন কাছাড় জেলার ১৩ জন অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সদস্য সেই প্রস্তাবিত বিলের বিপক্ষে ভোট দেন, কিন্তু এই বিপক্ষ ভোটের ফলে লাভের লাভ কিছুই হয়নি। যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেই সিদ্ধান্তেই বহাল থাকে শাসক দল অর্থাৎ প্রদেশ কংগ্রেস, বলে রাখা ভালো প্রদেশ কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তের পিছনে অসমিয়াদের চাপও ছিল যথেষ্ট। আর একটি বিষয় সেটা হলো , যে সময়কালে এই ঘটনা ঘটছে সেই সময়ে কংগ্রেস কিন্তু কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয়েরই শাসক দল। এবং সেই সময় এমন পরিস্থিতি তৈরী হয় যেখানে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়ে যায় বাঙালিদের ওপর বিদ্বেষ, বাড়িতে ঢুকে লুঠতরাজ থেকে শুরু করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া ,একের পর এক হত্যা, ধর্ষণ। এই পরিস্থিতির মধ্যেই সেই বছরেরই ২৪-শে অক্টোবর বিধানসভায় রাজ্যভাষা বিলটি পাশ হয়।
এই অত্যাচার , নিজের ভাষা বাঁচানোর তাগিদ এবং উদ্দাম অসমিয়া জাতীয়তাবাদের প্রতিবাদে তখন সরব হলেন মুষ্টিমেয় বাঙালি , কিন্তু প্রথমে সেই প্রতিবাদ আবেদন-নিবেদন, কথা বার্তার মধ্যে সীমিত থাকলেও পরবর্তীতে হিংসা ক্রমশই বাড়তে থাকায় শেষ পর্যন্ত পথে নামলো সাধারণ মানুষ। পথে নেমে সরকারি আদেশ, বাধা, নিষেধ যখন একে একে ছিন্ন করছে তারা ঠিক তখনই সরকারি রোষের মুখে আন্দোলনকারীরা। সেরকমই একটি আন্দোলন চলছিল শিলচর রেলস্টেশনে। জানা যায় ,আগে থেকেই ঘোষণা করা ছিল যে যদি এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখের মধ্যে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া না হয় তাহলে ১৯শে মে বৃহত্তর আন্দোলন এবং হরতালের পথে যাবেন। সাধারণভাবেই বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়না, আর পূর্ব কথা মতোই হরতালে নামেন আন্দোলনকারীরা। শিলচর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জে সকাল থেকেই শুরু হয় পিকেটিং। দুপুর অবধি সব শান্ত থাকলেও দুপুর ২ টোর পর পরিবেশ বদলাতে শুরু করে। স্টেশন চত্বরে উপস্থিত হয় অসম রাইফেলস। দুপুর ২.৩৫ , শুরু হয় লাঠিচার্জ। ওই পরিস্থিতিতে ৭ মিনিটের মধ্যেই আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে ১৭ রাউন্ড গুলি চালানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান ৯ জন আন্দোলনকারী এবং তার পরে মারা যান আরও ২ জন।এই নির্মম ঘটনার প্রতিবাদে সারাদেশ জুড়ে ক্ষোভ দাঁনা বাধে।যে আন্দোলন তৈরী হয়েছিল বরাক উপত্যকায়, সেই আন্দোলনের আঁচ এসে লাগে সমতলেও। ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পেরে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ছুটে এসেছিলেন উপত্যকায়। শাসক দল এবং উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের আন্দোলন দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। দফায় দফায় বৈঠক হয়। শেষ পর্যন্ত সমাধানসূত্র বের হয় লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর “শাস্ত্রী ফর্মুলা” এর মাধ্যমে। অসম সরকার শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে। যদিও আজ পর্যন্ত নিরীহ আন্দোলনকারীদের ওপর হওয়া নির্মম অত্যাচারের কোনো রকম বিচার হয়নি।
আজ হয়তো বাঙলিরা জানেনই না ১১ জন শহীদের নাম , বা কেউ কেউ হয়তো জানেননা ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী ছাড়াও বাঙালির আর একটি গর্বের দিন রয়েছে , যেদিন নিজের ভাষার জন্য নিজের দেশের পুলিশের কাছেই গুলি খেয়ে মরতে হয়েছিল ১১ জন ভাষা আন্দোলনকারীদেরকে , তারিখটা ১৯ শে মে , ১৯৬১।